সারভাইক্যাল স্পনডাইলোসিস: ঘাড়ের মেরুদণ্ডের ক্ষয়জনিত সমস্যা ও তার এর প্রতিকার

সারভাইক্যাল স্পনডাইলোসিস হলো ঘাড়ের মেরুদণ্ডের একটি ক্ষয়জনিত সমস্যা, যা আমাদের চল্লিশোর্ধ বয়সীদের মাঝে খুবই সাধারণ। এই রোগে ঘাড়ের ব্যথা থেকে শুরু করে বাহু, হাত ও আঙুলেও ব্যথা ও অবশ ভাব হতে পারে। সঠিক ফিজিওথেরাপি এবং চিকিৎসার মাধ্যমে এই সমস্যার থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। জেনে নিন সারভাইক্যাল স্পনডাইলোসিস সম্পর্কে বিস্তারিত এবং কীভাবে এটি প্রতিরোধ করা যায়।...

লেখকঃ ডাঃ মাসুদ উর রহমান

October 25, 2024

সারভাইক্যাল স্পনডাইলোসিস কী?

সারভাইক্যাল স্পনডাইলোসিস হলো মেরুদণ্ডের ঘাড়ের অংশে (সারভাইক্যাল স্পাইন) হাড়ের ক্ষয়জনিত একটি সমস্যা, যা সাধারণত বয়স বাড়ার সাথে সাথে ঘটে। আমাদের মেরুদণ্ডের প্রতিটি অংশে কিছু গর্ত থাকে, যার মাধ্যমে স্নায়ুগুলো দেহের অন্যান্য অংশে সংকেত প্রেরণ করে। সময়ের সাথে সাথে ঘাড়ের মেরুদণ্ডে অবস্থিত ডিস্ক, হাড় এবং জয়েন্টগুলোতে ক্ষয় হতে শুরু করে, যা থেকে ব্যথা এবং ঘাড়ের চলাফেরায় সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। সাধারণত চল্লিশোর্ধ বয়সের মানুষদের মধ্যে এটি বেশি দেখা যায়।

Cervical Sponsylosis treatment in rangpur Apex
সারভাইকাল পেইন

কারণ ও রিস্ক ফ্যাক্টর

  • বয়সজনিত ক্ষয়: বয়স বাড়ার সাথে সাথে মেরুদণ্ডের ডিস্ক এবং হাড়গুলো দুর্বল হয়ে যায়, যা ক্ষয়ের দিকে নিয়ে যায়।
  • অতিরিক্ত ওজন বহন করা: ঘাড়ের উপর অতিরিক্ত ওজনের চাপ পড়লে মেরুদণ্ডের ক্ষয় ত্বরান্বিত হতে পারে।
  • দীর্ঘ সময় বসে কাজ করা: যারা দীর্ঘ সময় ধরে কম্পিউটারের সামনে বসে কাজ করেন, তাদের এই রোগের ঝুঁকি বেশি।
  • অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম: ভারী কিছু তোলা বা অতিরিক্ত ঘাড়ের মুভমেন্টও এই রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
  • জেনেটিক বা পারিবারিক ইতিহাস: কিছু মানুষদের মধ্যে জেনেটিক কারণে সারভাইক্যাল স্পনডাইলোসিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।

লক্ষণসমূহ

সারভাইক্যাল স্পনডাইলোসিসের লক্ষণগুলো ধীরে ধীরে প্রকাশ পায় এবং ঘাড়ের ব্যথা থেকে শুরু করে বাহু, হাত এবং আঙুলেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। সাধারণত এই রোগের লক্ষণগুলো হলো:

  • ঘাড়ের ব্যথা: ঘাড়ের পেছনের দিকে ব্যথা অনুভূত হয়, যা সময়ের সাথে বাড়তে থাকে।
  • কাঁধ এবং বাহুতে ব্যথা: ব্যথা কাঁধ, বাহু ও হাতের আঙুল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে।
  • ঘাড়ের স্টিফনেস: ঘাড়ের পেশিগুলো শক্ত হয়ে যেতে পারে, মনে হবে ঘাড় জমে আছে এবং নড়াচড়া করতে অসুবিধা হয়।
  • হাত ও আঙুলে অসাড় ভাব: বাহু এবং আঙুলের অস্বাভাবিক অনুভূতি বা অবশ ভাব দেখা দিতে পারে।
  • মাথা ঘোরানো: ঘাড়ের ব্যথা মাথা ঘোরানোর সময় বাড়তে পারে, এবং মাথার পিছনে বা কানের পেছনে চাপ অনুভব করতে পারেন।
  • মাথা ও ঘাড়ে তীক্ষ্ণ ব্যথা: ভারী কিছু তোলার পর বা অতিরিক্ত কাজের ফলে তীক্ষ্ণ ব্যথা দেখা দিতে পারে।

চিকিৎসা পদ্ধতি

সারভাইক্যাল স্পনডাইলোসিসের চিকিৎসা রোগীর অবস্থার উপর নির্ভর করে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ওষুধ, ফিজিওথেরাপি এবং জীবনধারায় কিছু পরিবর্তনই যথেষ্ট হয়ে থাকে। নিচে এর চিকিৎসার ধাপগুলো তুলে ধরা হলো:

০১ ফিজিওথেরাপি:

ফিজিওথেরাপি সারভাইক্যাল স্পনডাইলোসিসের চিকিৎসায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি ঘাড়ের পেশিগুলোর কার্যক্ষমতা পুনরুদ্ধার করে, ব্যথা কমায়, এবং রোগীর নিত্যদিনের জীবনযাত্রা সহজ করে। সারভাইক্যাল স্পনডাইলোসিসের জন্য কিছু বিশেষ ধরনের ফিজিওথেরাপি করা হয়, যেমন:

মাসল রিলিজ করছেন চিকিৎসক
মাসল রিলিজ করছেন চিকিৎসক
  • স্ট্রেচিং ও স্ট্রেন্থেনিং এক্সারসাইজ: ঘাড়ের মাংসপেশি ও জয়েন্টের মুভমেন্ট এবং পেশির শক্তি বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত স্ট্রেচিং এবং স্ট্রেন্থেনিং ব্যায়াম করা হয়।
  • মাসাজ ও ম্যানুয়াল থেরাপি: পেশিগুলোর রক্ত সঞ্চালন বাড়াতে এবং ব্যথা কমাতে ঘাড়ে বিশেষ ধরনের ম্যাসাজ করা হয়।
  • ইলেকট্রোথেরাপি: UST (আল্ট্রাসাউন্ড থেরাপি) এবং SWT (শকওয়েভ থেরাপি) সারভাইক্যাল স্পাইনকে আরোগ্য করতে অত্যন্ত কার্যকরী। এগুলো পেশিগুলোর ফাংশন পুনরুদ্ধারে সাহায্য করে।

০২ ব্যথানাশক ওষুধ:

প্যারাসিটামল বা ন্যাপ্রোক্সেনের মতো ব্যথানাশক ওষুধ ব্যথা কমাতে সহায়ক।

০৩ বিশ্রাম:

অতিরিক্ত ঘাড়ের নড়াচড়া এড়িয়ে চলতে হবে এবং প্রয়োজন হলে সারভাইক্যাল স্প্লিন্ট ব্যবহার করতে হবে।

০৪ জীবনযাপনের পরিবর্তন:

দীর্ঘ সময় ধরে একটানা কাজ না করা, সঠিক পদ্ধতিতে বসা এবং নিয়মিত শরীরচর্চা করা জরুরি।

লাইফস্টাইল পরিবর্তন এপেক্স ফিজিওথেরাপি সেন্টারে
লাইফস্টাইল পরিবর্তন এপেক্স ফিজিওথেরাপি সেন্টারে

জীবনযাত্রা পরিবর্তন ও সাধারণ পরামর্শ

  • সঠিকভাবে বসা: দীর্ঘ সময় কম্পিউটারের সামনে কাজ করলে অবশ্যই মাঝে মাঝে বিরতি নিতে হবে এবং সঠিকভাবে বসা শিখতে হবে।
  • শরীরচর্চা: নিয়মিত ঘাড়ের ব্যায়াম করতে হবে যাতে পেশিগুলো নমনীয় থাকে এবং ক্ষয়ের হার কমে।
  • ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা: শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে যাতে মেরুদণ্ডের উপর অতিরিক্ত চাপ না পড়ে।
  • অতিরিক্ত ভারী কাজ এড়িয়ে চলা: অতিরিক্ত ভারী কিছু তোলা বা বেশি পরিশ্রম এড়িয়ে চলতে হবে।

উপসংহার

সারভাইক্যাল স্পনডাইলোসিস এমন একটি অবস্থা যা সঠিক চিকিৎসা এবং যত্নের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। ফিজিওথেরাপির সাহায্যে এই সমস্যার লক্ষণগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং দৈনন্দিন জীবনে স্বাভাবিকভাবে ফিরে আসা সম্ভব। সঠিক জীবনধারা মেনে চলা এবং শরীরের প্রতি যত্নশীল থাকলেই সারভাইক্যাল স্পনডাইলোসিসের ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব। এই সমস্যাটি সমাধানে সর্বাধুনিক চিকিৎসা রয়েছে এপেক্স ফিজিওথেরাপি সেন্টারে। তাই ভিজিট করুন আমাদের সেন্টার।

Masud Ur Rahman best physiotherapist

ডাঃ মাসুদ উর রহমান

বাত-ব্যথা,প্যারালাইসিস, ঘাড় /কোমর/ হাটু/ গোড়ালি ব্যথা, হাত- পা ঝিনঝিন / অবশ হয়ে যাওয়া, মুখ বাকা হয়ে যাওয়া, খেলাধুলা / আঘাত জনিত ব্যথা এবং প্রতিবন্ধী শিশুদের বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার চিকিৎসায় আমি একজন বিশেষজ্ঞ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক। আমার মূল লক্ষ্য হলো আপনাকে সুস্থভাবে চলাফেরা করতে সাহায্য করা এবং আপনার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা।

0 Comments

Submit a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

অন্যান্য ব্লগ

স্ট্রোক পরবর্তী পুনর্বাসন: সুস্থ জীবনে ফেরার উপায়, জানুন এবং প্রতিরোধ করুন

স্ট্রোক পরবর্তী পুনর্বাসন: সুস্থ জীবনে ফেরার উপায়, জানুন এবং প্রতিরোধ করুন

স্ট্রোকের পর যে প্যারালাইসিস, কথা বলার সমস্যাসহ বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয়, তার জন্য প্রয়োজন বিশেষ যত্ন এবং চিকিৎসা। এই ব্লগে স্ট্রোকের কারণ, লক্ষণ, তাৎক্ষণিক করণীয়, প্রতিরোধের উপায় এবং ফিজিওথেরাপির গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।

ডিস্ক প্রলাপস: ঘাড় এবং কোমড়ে অসহ্য ব্যথা থেকে মুক্তির সহজ পথ

ডিস্ক প্রলাপস: ঘাড় এবং কোমড়ে অসহ্য ব্যথা থেকে মুক্তির সহজ পথ

ডিস্ক প্রলাপস, যা ডিস্ক হার্নিয়েশন নামেও পরিচিত, একটি প্রচলিত সমস্যা যা মেরুদণ্ডের স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। এই ব্লগ পোস্টে আমরা ডিস্ক প্রলাপসের কারণ, উপসর্গ, চিকিৎসা, ফিজিওথেরাপির ভূমিকা এবং রোগীকে দেওয়ার সাধারণ পরামর্শ আলোচনা করব।

বেলস্ পালসি ( মুখ বাকা হয়ে যাওয়া) : ফেসিয়াল নার্ভের সমস্যা ও দ্রুত নিরাময়ের উপায়

বেলস্ পালসি ( মুখ বাকা হয়ে যাওয়া) : ফেসিয়াল নার্ভের সমস্যা ও দ্রুত নিরাময়ের উপায়

বেলস্ পালসি হলো মুখের ফেসিয়াল নার্ভের একটি তীব্র প্রদাহজনিত সমস্যা, যা মুখের এক পাশ দুর্বল করে দেয় বা সম্পূর্ণ প্যারালাইজড করে ফেলে। এই রোগ সাধারণত ঋতু পরিবর্তনের সময়ে বেশি দেখা যায়। সঠিক চিকিৎসা ও ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে বেশিরভাগ রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন।

টেনিস এলবো: কেবল খেলোয়াড় নয়, আপনিও হতে পারেন ভুক্তভোগী—জানুন এর কারণ, লক্ষণ ও সহজ চিকিৎসা

টেনিস এলবো: কেবল খেলোয়াড় নয়, আপনিও হতে পারেন ভুক্তভোগী—জানুন এর কারণ, লক্ষণ ও সহজ চিকিৎসা

টেনিস এলবো কেবল খেলোয়াড়দের নয়, যেকোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে হতে পারে যারা বারবার হাতের মুভমেন্ট করে থাকেন। কীভাবে এই সমস্যা চিহ্নিত করবেন এবং এর চিকিৎসা ও ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে কীভাবে উপশম পেতে পারেন তা জানুন।

পাইরিফরমিস সিনড্রোম: এটি কেন হয় এবং কীভাবে ফিজিওথেরাপি আপনাকে সাহায্য করতে পারে

পাইরিফরমিস সিনড্রোম: এটি কেন হয় এবং কীভাবে ফিজিওথেরাপি আপনাকে সাহায্য করতে পারে

পায়ের নিচ থেকে কোমর পর্যন্ত ব্যথা? পা ভারি ভারি বা অবশ লাগছে? হয়তো এটি ডিস্ক প্রলাপস নয়, বরং পাইরিফরমিস সিনড্রোম হতে পারে। এই সমস্যা কীভাবে ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে উপশম করা সম্ভব তা জানুন।

মায়োফেসিয়াল পেইন সিনড্রোম: এক রহস্যময় ব্যথার কারণ

মায়োফেসিয়াল পেইন সিনড্রোম: এক রহস্যময় ব্যথার কারণ

অনেক সময় আমরা ব্যথার প্রকৃত কারণ খুঁজে পাই না। ঘাড়, কাঁধ বা কোমরের এই ব্যথা এক্সরে বা এম.আর.আই.-তে ধরা পড়ে না, কিন্তু সেই ব্যথা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কষ্ট দেয়। মায়োফেসিয়াল পেইন সিনড্রোম এমনই একটি রোগ, যা নিয়ে সচেতন হওয়া প্রয়োজন।

Pin It on Pinterest

Share This