টেনিস এলবো কী?
টেনিস এলবো, যার বৈজ্ঞানিক নাম ল্যাটারাল এপিকন্ডাইলাইটিস, হলো কনুইয়ের বাইরের দিকে একটি ব্যথাজনিত অবস্থা। এটি কনুইয়ের ল্যাটারাল এপিকন্ডাইলের কাছে অবস্থিত টেন্ডনের প্রদাহ বা ক্ষত থেকে হয়। এটি সাধারণত হাতের এবং কব্জির অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে, বিশেষ করে পুনরাবৃত্তিমূলক মুভমেন্টের কারণে হয়, যা এই টেন্ডনকে অবসন্ন করে তোলে।
যাদের বেশী হয়
যদিও টেনিস খেলার সাথে এর নাম জড়িত, তবুও যেকোনো এথলেট/ খেলোয়াড় ব্যক্তির এই অবস্থা হতে পারে যারা হাত ও কব্জি নিয়মিত ব্যবহার করেন (যেমনঃ ক্রিকেট, গলফ, ব্যাডমিন্টন ইত্যাদি) এটি হতে দেখা যায়। এমনকি অন্য পেশার লোক যাদের হাতের কাজ বেশী করতে হয় যেমন রাঁধুনি, মেকানিক, কারিগর, বা টাইপিস্ট – তাদেরও এ সমস্যা হয়ে থাকে।
টেনিস এলবোর কারণসমূহ
টেনিস এলবো সাধারণত পুনরাবৃত্তিমূলক কাজের কারণে হয় যা কব্জির টেন্ডন এবং মাংসপেশীতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। ফলে সেখানে প্রদাহ হয় ও ফুলে যায়। এর প্রধান কারণগুলির মধ্যে রয়েছে:
- টেনিস বা অন্যান্য র্যাকেট খেলা: বিশেষত ভুল ফর্মে বা অনিয়মিত র্যাকেট ব্যবহার করলে এই সমস্যা হতে পারে।
- অন্যান্য পুনরাবৃত্তিমূলক কাজ: যেকোনো কাজ যেখানে কব্জি এবং হাত বারবার ব্যবহার হয়, যেমন ভারী জিনিস তোলা, টাইপ করা, বা আঁকাআঁকি করা।
- অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ: হাত ও কব্জিতে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করেও টেনিস এলবো হতে পারে। বিশেষ করে যদি একই ধরনের মুভমেন্ট দীর্ঘ সময় ধরে করা হয়।
লক্ষণসমূহ
টেনিস এলবো কনুইয়ের বাইরের দিকে ব্যথা অনুভবের মাধ্যমে প্রকাশ পায়, যা কব্জি, হাত এবং আঙ্গুলের দিকে ছড়িয়ে পড়তে পারে। লক্ষণগুলো সাধারণত ধীরে ধীরে শুরু হয় এবং সময়ের সাথে সাথে তীব্র হতে পারে।
- কনুইয়ের বাইরের দিকে ব্যথা এবং বিভিন্ন কাজকর্মে (রান্না করার সময়/ কাপড় মোচড়ানোর সময়/ স্ক্রু – ড্রাইভার দিয়ে কাজ করার সময়) তা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়।
- কব্জির নড়াচড়ায় ব্যথা।
- হাতে শক্তি কমে যাওয়া।
- মুঠো বানাতে বা ছোট জিনিস ধরতে অসুবিধা।
- হাত ব্যবহার করলে ব্যথা বেড়ে যাওয়া।
রোগ নির্ণয়
একজন অভিজ্ঞ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক সাধারণত টেনিস এলবো রোগের নির্ণয় করতে পারেন। এটি ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার মাধ্যমে করা হয়, যেখানে কনুই, কব্জি এবং হাতের মুভমেন্ট পরীক্ষা করা হয় (কোজেন টেস্ট)। বিশেষ টেন্ডার পয়েন্টে চাপ দিলে রোগী ব্যথা অনুভব করতে পারেন। যদি রোগটি গুরুতর হয়, তাহলে রেডিওলজিক্যাল পরীক্ষা (এক্স-রে, এমআরআই) প্রয়োজন হতে পারে, যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি ক্লিনিক্যাল পর্যবেক্ষণেই নির্ণয় করা যায়।
চিকিৎসা পদ্ধতি
টেনিস এলবো সাধারণত নন-সার্জিকাল উপায়ে নিরাময়যোগ্য। সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিলে এবং নিয়মিত ফিজিওথেরাপি সেশন নিলে বেশিরভাগ রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন। চিকিৎসার ধাপগুলো নিম্নরূপ:
১. বিশ্রাম ও পুনরাবৃত্তিমূলক কাজ এড়ানো:
প্রথমে হাত ও কব্জির উপর চাপ কমাতে হবে এবং পুনরাবৃত্তিমূলক কাজ এড়িয়ে চলতে হবে।
২. ব্যথানাশক ওষুধ:
প্রদাহ কমাতে এবং ব্যথা উপশম করতে নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগস (NSAIDs) দেওয়া হয়।
৩. ফিজিওথেরাপি:
ফিজিওথেরাপি টেনিস এলবোর দীর্ঘস্থায়ী চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফিজিওথেরাপি পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে:
- স্ট্রেচিং ও স্ট্রেংথনিং এক্সারসাইজ: কব্জি, হাত এবং কনুইয়ের স্ট্রেচিং ও শক্তিশালীকরণ ব্যায়াম ফিজিওথেরাপির মূল অংশ। এটি টেন্ডনের টান কমিয়ে মাংসপেশী শক্তি বাড়াতে সহায়ক।
- ম্যানুয়াল থেরাপি: ফিজিওথেরাপিস্টের মাধ্যমে কনুই এবং কব্জির নির্দিষ্ট টেন্ডন ও মাংসপেশীগুলোর ম্যাসাজ (DTFM) এবং ম্যানুয়াল থেরাপি করানো হয়।
- ইলেকট্রোথেরাপি (ইলেকট্রিক্যাল সিমুলেশন ও আল্ট্রাসাউন্ড থেরাপি): ইলেকট্রোথেরাপির মাধ্যমে প্রদাহ কমিয়ে ব্যথা উপশম করা যায়। আল্ট্রাসাউন্ড থেরাপি টেন্ডনের মাইক্রো-টিস্যু পুনরুদ্ধারে সহায়ক।
- কাইনেসিও টেপিং: এই পদ্ধতিতে কব্জি ও কনুইতে টেপ ব্যবহার করা হয় যা মাংসপেশী ও টেন্ডন সঠিকভাবে স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে।
৪. ইনজেকশন থেরাপি:
গুরুতর ক্ষেত্রে স্টেরয়েড ইনজেকশন ব্যবহার করা হতে পারে, তবে এটি একটি অস্থায়ী সমাধান। তাই না করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
টেনিস এলবো প্রতিরোধে ঘরোয়া ব্যায়াম
টেনিস এলবো সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ফিজিওথেরাপির পাশাপাশি কিছু বাড়িতে করা যায় এমন ব্যায়াম রোগীদের উপশম এনে দেয়। নিচের ব্যায়ামগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে উপকারী হতে পারে:
- কব্জির স্ট্রেচিং: একটি টেবিলের উপর হাত রেখে কব্জি ধীরে ধীরে সামনে পেছনে স্ট্রেচ করুন। এই পদ্ধতি টেন্ডনগুলোর টান কমায়।
- রাবার বল স্কুইজিং: রাবার বল বা স্ট্রেস বল হাতে চেপে ধরা এবং ছেড়ে দেওয়ার মাধ্যমে হাতের মাংসপেশী ও টেন্ডনের শক্তি বাড়ানো যায়।
- আঙ্গুলের স্ট্রেংথেনিং: আঙ্গুল দিয়ে রাবার ব্যান্ড টেনে ধরার মাধ্যমে আঙ্গুলের মাংসপেশী শক্তিশালী করা সম্ভব।
উপসংহার
টেনিস এলবো একটি সাধারণ কিন্তু কষ্টদায়ক সমস্যা, যা প্রায়ই পুনরাবৃত্তিমূলক কাজের ফলে হয়। সঠিক সময়ে ফিজিওথেরাপি ও ব্যায়ামের মাধ্যমে এটি সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। দীর্ঘ সময় ধরে হাতের অতিরিক্ত ব্যবহার বা ভুল মুভমেন্ট এড়িয়ে চললে এই সমস্যার পুনরাবৃত্তি কমানো সম্ভব। ব্যথা শুরু হলে দেরি না করে একজন ফিজিওথেরাপিস্টের পরামর্শ নেওয়া উচিত, যাতে চিকিৎসার মাধ্যমে দ্রুত উপশম পাওয়া যায়।
এপেক্স ফিজিওথেরাপি সেন্টারে রয়েছে ডাঃ মাসুদ উর রহমান। যিনি বাত-ব্যথা,প্যারালাইসিস, ঘাড় /কোমর/ হাটু/ গোড়ালি ব্যথা, হাত- পা ঝিনঝিন / অবশ হয়ে যাওয়া, মুখ বাকা হয়ে যাওয়া, খেলাধুলা / আঘাত জনিত ব্যথা এবং প্রতিবন্ধী শিশুদের বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার চিকিৎসায় একজন বিশেষজ্ঞ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক। আপনার টেনিস এলবো সহ অন্য যেকোন শারীরিক সমস্যা সমাধানে ভিজিট করতে পারেন আমাদের সেন্টার।
0 Comments